ঢামেক ওসিসিতে থাকা ১৩ জনই ধর্ষণের শিকার

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) সেন্টারে বেড রয়েছে আটটি। সোমবার ( ১৩ জানুয়ারি) সেখানে ভিকটিম ভর্তি আছেন ১৩ জন। তারা সবাই ধর্ষণের শিকার। এর মধ্যে যেমন ২৫ বছরের নারী রয়েছেন, তেমনি আছেন ১০ বছর বয়সের শিশুও। বেড কম থাকায় ওসিসির ভেতরে একেক বেডে দুই থেকে তিনজন করেও রাখা হচ্ছে। ওসিসিতে দায়িত্ব পালনকারী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওসিসিতে আগে শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানির শিকার নারীরা এলেও গত কয়েক বছরে ধর্ষণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। যে পরিমাণ ধর্ষণের শিকার নারী এখানে আসে তাতে করে পুরো দেশের চিত্রটা তাদের কাছে পরিষ্কার। আর ওসিসিতে আসা নারীর মধ্যে ১০ থেকে ২০ বছর বয়সী নারীর সংখ্যাই শতকরা ৫০ শতাংশ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়কারী ডা. বিলকিস বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকেই ধর্ষণের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। শুধুমাত্র ঢামেক হাসপাতালে যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে সারাদেশের অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ তা আঁচ করা যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যা কিনা ২০১৮ সালে ছিল ৭৩২ জন, ২০১৭ সালে ছিল ৮১৮ জন। অন্যদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জানায়, ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯০২ শিশু, ২০১৮ সালে যে সংখ্যা ছিল ৩৫৬। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের চাইল্ড প্রোটেকশন কো-অর্ডিনেটর রাফিজা শাহীন জানান, গত বছরে ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সাত থেকে ১২ বছরের শিশু ছিল ৩৯ শতাংশ আর ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছিল ৪৮ শতাংশ। ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ৭৬.০১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)। শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গতবছর এক হাজার পাঁচটি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৭৬ দশমিক ০১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে প্রতিমাসে গড়ে ৮৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
সংগঠনটি জানায়, ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। আক্রান্তদের মধ্যে ১৩৩ জনের বয়স ছিল এক থেকে ছয় বছরের মধ্যে। ঢাকা জেলায় ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫টি জাতীয় দৈনিক থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। বিএসএএফের তথ্যানুযায়ী, ভুক্তভোগী শিশুদের মধ্যে ৭৫ জন তাদের শিক্ষক এবং ১৪১ জন প্রতিবেশীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
সোমবার ঢামেকের ওসিসিতে সরেজমিনে দেখা যায়, রবিবার (১২ জানুয়ারি) রাতে নরসিংদীতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়। সোমবার সকালে শিশুটিকে তার স্বজনরা ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসেন। তারা জানান, রবিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাসার পাশের এক দোকানে কলা কিনতে গেলে দোকানি মেয়েটির হাত পা বেঁধে ধর্ষণ করে। মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে এবং পরে ওসিসিতে নিয়ে আসেন। এদিকে, সোমবারই সাভার থেকে এসেছে ধর্ষণের শিকার পাঁচ বছরের এক শিশু। সকাল ১১টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। গত ৯ জানুয়ারি কামরাঙ্গীরচর এলাকাতে ধর্ষণের শিকার হয় ১৩ বছরের কিশোরী, পরদিন তাকে ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। একইদিন রাতে ভাটারা এলাকাতে ধর্ষণের শিকার হয় ১২ বছরের এক শিশু। এদিকে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে এই মুহূর্তে ভর্তি আছেন ১৩ জন, যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৪ থেকে ৬ বছরের শিশুও রয়েছে। বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি রয়েছেন ধর্ষণের শিকার দুই কিশোরী, তাদের বয়স ১৪ এবং ১৭। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি আছেন দুইজন যাদের বয়স ১৬ এবং ২০। তারাও ধর্ষণের শিকার।ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এই মুহূর্তে ওসিসিতে কেউ ভর্তি নেই। তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই ধর্ষণের শিকার বেশ কিছু শিশু ভর্তি ছিল। যাদের মধ্যে এক শিশুর বয়স ছিল ৪। ওই কর্মকর্তা বলেন, এই ওসিসিতে ধর্ষণের শিকার হয়ে আসা নারীর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি থাকে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি থেকে জানা যায়, সেখানে ধর্ষণের শিকার ১০ বছরের এক কিশোরী ভর্তি আছে।
ঢামেকের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়কারী ডা.বিলকিস বেগম বলেন,২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকেই ধর্ষণের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ নারী এবং শিশু। সেখানে নারী এবং শিশুরাই যদি এভাবে নির্যাতিত হয় তাহলে দেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, দেশে আইন আছে। কিন্তু নানা কারণেই ধর্ষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। আর ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে চার মাসের শিশুও এসেছে এখানে। শিশু-কিশোরীই বেশি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাধারণত আত্মীয়-স্বজন, পাশের দোকানদার, ঘরের পাশে থাকা রিকশাচালকদের দ্বারা এই ধর্ষণগুলো বেশি হচ্ছে। আর শিশুদের যেহেতু প্রতিরোধক্ষমতা নেই,তাদেরকে সহজেই অনেক কিছু বোঝানো যায়, ভয় দেখানো যায় তাই এই সংখ্যাটা বেশি। আর ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার,পরিবারের বন্ধন কমে যাওয়াও ধর্মীয় অনুশাসন না থাকা এবং সমাজের অবক্ষয়ের কথা উল্লেখ করেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন,সাম্প্রতিক সময়ে নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং ধর্ষণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সামাজিক অস্থিরতা এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এটা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন,বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে রোল মডেল হলেও ধর্ষণের এই ঘটনা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। শিশুরা হচ্ছে সবচাইতে দুর্বল গোষ্ঠী,আর তারা যেহেতু দুর্বল, তাই তারা সহজ টার্গেট এবং সহজ শিকার,তাদেরকে সহজেই প্রলোভনে ফেলা যায়— মন্তব্য করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মা-বাবার ব্যস্ততা ও পরিবারের বড়দের অন্য কাজে বেশি ডাইভারসিটি বেড়ে যাওয়ায় শিশুদের প্রতি নিরাপত্তাবোধের জায়গা এবং তাদেরকে নিরাপদ রাখার জায়গাগুলো অনেক শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তবে সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন জানালে তিনি বলেন, কারণ এই শিশুদের সহজে প্রলোভিত করা যায়। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটাও নাজুক থাকে।