যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলার হুমকি

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ মুখোমুখি অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ‘বারুদের বাক্সে ডিনামাইট ছুড়ে দিয়েছেন’। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে গ্রিন জোনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বাইরে রকেট হামলা হয়েছে। ইরানের কোম নগরীতে জামখারান মসজিদে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে লাল পতাকা, যার অর্থ তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এই লাল পতাকা দিয়ে যুদ্ধ এবং প্রতিশোধ বোঝানো হয়। এই পতাকার ছবি প্রচার করেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় এই দুটি দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এ আশঙ্কাকে সামনে রেখে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে টার্গেট স্থির করেছে। ইরানের ৫২টি স্থাপনার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র তাক করে আছে। মার্কিনি অথবা মার্কিন কোনো সম্পদের ওপর তেহরান হামলা চালালে গর্জে উঠবে সেসব অস্ত্র। নিমিষে বিলীন হয়ে যেতে পারে ইরানের ওইসব স্থাপনা। ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে এসব কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এক টুইটে তিনি বলেছেন, সামরিক সরঞ্জাম খাতে ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বে আমরাই সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সেরা (সামরিক দিক থেকে)। ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাঁটি অথবা কোনো মার্কিনির ওপর হামলা করে তাহলে কোনো দ্বিধা না করে এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করবো আমরা।
শুক্রবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আকাশপথে হামলায় নিহত হন ইরানের কুদ্‌স ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। এই শোককে বুকে ধারণ করে ফুঁসছে ইরান। তারা এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। ইসরাইলের তেলআবিবসহ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি টার্গেটে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে ইরান। কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে এমন হুমকি দিয়েছেন ইরানের সিনিয়র একজন কমান্ডার। তিনি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরমান প্রদেশে রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোরের কমান্ডার জেনারেল গোলাম আলি আবু হামজে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন টাইমস অব ইসরাইল, বিবিসি, বৃটেনের মেট্রো। গোলাম আলি বলেছেন, পশ্চিমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট হলো হরমুজ প্রণালী। এখান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক ডেস্ট্রয়ার এবং যুদ্ধজাহাজ অতিক্রম করে। অনেক আগেই এখানে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে নিশানা করেছে ইরান। ‘তেলআবিব সহ এই অঞ্চলে মার্কিন ৩৫টি টার্গেট রয়েছে আমাদের সক্ষমতার অধীনে’। এমনই পাল্টাপাল্টি টার্গেট নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। ওদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটারে লিখেছেন, জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুর জবাব দিতে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কিছু ‘অ্যাসেট’ টার্গেট করেছে খুব জোরালোভাবে। তিনি আরো বলেছেন, ইরানের ৫২টি স্থাপনা শনাক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে অনেক স্থাপনা আছে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার, ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং ইরানের সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট। ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা চালায় তাহলে, যেসব স্থাপনা টার্গেট করা হয়েছে তা এবং ইরান নিজে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে আক্রান্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র আর হুমকির কারণ হতে চায় না।
এখানেই থেমে যাননি ট্রাম্প। বলেছেন, ১৯৭৯ সাল থেকে কমপক্ষে এক বছর ধরে ইরান যে ৫২ মার্কিনিকে জিম্মি করে রেখেছিল তার বিপরীতে ওই ৫২টি স্থাপনা টার্গেট করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে তেহরানে ইসলামিক বিপ্লবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস দখল করে নেয় বিপ্লবীরা। এ সময় সেখানে চালানো হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। ওদিকে ট্রাম্পের টুইটের পর মার্কিন সরকারের একটি এজেন্সির ওয়েবসাইট হ্যাক করে ‘ইরান সাইবার সিকিউরিটি গ্রুপ হ্যাকারস’। এই এজেন্সিটি হলো আমেরিকান ফেডারেল ডিপোজিটরি লাইব্রেরি প্রোগ্রাম। এই সাইটটি খুললেই সেখানে লেখা উঠছিল ‘দিস ইজ এ ম্যাসেজ ফ্রম দ্য ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান’। অর্থাৎ এই বার্তাটি হলো ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের। এতে আরো বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে আমাদের বন্ধুদের সমর্থন দেয়া বন্ধ করবো না আমরা। ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া সরকার, ইরাকের জনগণ এবং সরকার, বাইরাইনের নির্যাতিত জনগণ, লেবানন ও ফিলিস্তিনি মুজাহিদীনদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে আমরা সমর্থন দিয়ে যাবো। তারা সব সময়ই আমাদের তরফ থেকে সমর্থন পাবে। এই ওয়েবসাইটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি কারসাজি করা ছবি পোস্ট করা হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে তার মুখে আঘাত করা হয়েছে এবং মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। এর পরেই হ্যাকাররা লিখেছে, এটা ইরানের সাইবার সক্ষমতার সামান্য একটু অংশ।
শনিবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদে জেনারেল সোলাইমানি ও শুক্রবার নিহত অন্যদের মৃতদেহ নিয়ে বিশাল শোকর‌্যালি করেন শোকার্ত জনতা। এ সময় তারা ইরাক ও মিলিশিয়াদের পতাকা দুলিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন ‘আমেরিকা নিপাত যাক’। কিছুক্ষণ পরই কয়েকটি রকেট হামলা হয়। গ্রিন জোন বলে পরিচিত অত্যন্ত নিরাপত্তা সংবলিত ও স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কাছে একটি রকেট হামলা হয়। ইরাকের মিলিশিয়ারা বলেছে, এতে কেউ আহত হয়নি। তবে কে বা কারা এই হামলা চালিয়েছে তা কোনো পক্ষ স্বীকার করেনি। তবে সাম্প্রতিক এমন হামলার জন্য দায়ী করা হয়েছে ইরানপন্থিদের। এসব ঘটনার পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই টুইট করেন। কুদ্‌স ফোর্সের কমান্ডার সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে জানান দিয়েছে ইরান। তবে যদি তারা এই পথেই হাঁটে তাহলে পরিণতি কি হবে সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন ট্রাম্প। তিনি যেসব টার্গেটের কথা বলেছেন, তার মধ্যে ইরানের সাংস্কৃতিক অঙ্গন রয়েছে। এটির নেতৃত্ব, সেনাবাহিনী অথবা অর্থনীতির চেয়েও বড় একটি ক্ষেত্র। সোলাইমানিকে হত্যার পর পরিস্থিতিকে সামলে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছেন ট্রাম্প। কিন্তু বল এখন ইরানের কোটে। তারা এখন কোন পথ অবলম্বন করে তা দেখার বিষয়। এ অবস্থায় ইরানকে সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোমিনিক রাব। কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। ওদিকে হরমুজ প্রণালিতে বৃটেনের পতাকাবাহী তেলের ট্যাংকারগুলোকে নিরাপত্তা দিতে দুটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি সাবমেরিন মোতায়েন করছে বৃটেন।
ইরানের পবিত্র জামখারান মসজিদে উড়লো যুদ্ধ ঘোষণার লাল পতাকা : মুসলিমদের পবিত্র শহর কোমের জামখারান মসজিদ থেকে লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে ইরান। ইতিহাসে এটিই মুসলিমদের নিকট পবিত্র এই গম্বুজের উপরে লাল পতাকা উড়ানোর প্রথম ঘটনা। শুক্রবার আল কুদ্‌স ব্রিগেডের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া তেহরান। তার প্রতীক হিসেবেই উড়ানো হয়েছে এই লাল পতাকা। এটি প্রতিশোধের প্রতীক। এর অর্থ হলো ইরানের জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলা। এ খবর দিয়েছে বৃটেনভিত্তিক মেট্রো। দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তেলচিত্র ভাইরাল হয়েছে- যাতে দেখানো হয়েছে, কারবালায় শহীদ হওয়া ইমাম হোসেইন (রা.) তার বুকে জড়িয়ে রেখেছেন মার্কিন হামলায় নিহত সোলাইমানিকে। সেখান থেকে গত দু’দিন ধরে প্রচার হচ্ছে প্রতিশোধের আহ্বান। রোববার ইরানে সোলাইমানির মরদেহ আসলে রাস্তায় শোক জানাতে নেমে আসেন লাখো মানুষ। তাদের মুখে শুধু একটিই কথা ছিল- প্রতিশোধ। এরইমধ্যে উড়িয়ে দেয়া হলো লাল পতাকা। মসজিদের উপরে লাল পতাকা উড়ানো হচ্ছে দেশের মানুষকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা। মেট্রো জানিয়েছে, এটি প্রমাণ করে প্রতিশোধের জন্য ইরান কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। লাল পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সমপ্রচার করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বিশেষ করে ইরানি সংস্কৃতিতে লাল পতাকা হচ্ছে কোনো হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার প্রতীক। ৬৮০ সালে ইমাম হোসেইন কারবালার যুদ্ধে ‘শহীদ’ হন। তার মাজারেই প্রথম এই লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো। এরপর থেকে এখনো সেই পতাকা নামানো হয়নি। এই পতাকা সেদিনই নামানো হবে যেদিন ইমাম হোসেইনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া হবে।