ঝিনাইদহে সাংবাদিক পুলিশ ও মানবাধিকার কর্মী সেজে প্রতারণা

0

স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ॥ এক সময় ঝিনাইদহ অঞ্চলে চরমপন্থিদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে গ্রামে বসবাস করতে হতো মানুষকে। চাঁদার টাকা পরিশোধ না করলে নিরীহ মানুষদের গুলি করে বা গলাকেটে হত্যার পর আতংকা ছড়িয়ে দেয়া হতো। আতংকের সেই পরিবেশ এখন আর নেই। কিন্তু এখন চরমপন্থিদের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ডিজিটাল চাঁদাবাজি। সাংবাদিক, পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মী সেজে এক শ্রেণির প্রতারক জেলাব্যাপী ভয়ংকর চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তায় হরহামেশা দেখা মিলছে প্রেস, মানবাধিকার ও পুলিশ লেখা স্টিকারযুক্ত মোটরসাইকেলের। এই প্রতারকরা এতটাই সংঘবদ্ধ যে এরা দল বেঁধে সরকারি কর্মকর্তা বা গ্রামের মানুষকে টার্গেট করছে। চাহিদা মতো টাকা না দিলে ফেক ফেসবুক আইডিতে ভিডিও বা ছবি দিয়ে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন ঝিনাইদহের গ্রামেগঞ্জে এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও মানুষ কোন প্রতিকার পাচ্ছে না।
মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দিয়ে এমন এক চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে কোটচাঁদপুরের ফুলবাড়িয়া গ্রামে। জনৈক রবীন্দ্র্রনাথ ঘোষ মানবাধিকার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ফুলবাড়ি গ্রামের হারান বিশ্বাসের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গত অক্টোবর মাসে ফুলবাড়ি গ্রামের হারান বিশ্বাসের মেয়ে প্রীতি বিশ্বাস বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় হারান বিশ্বাস কোটচাঁদপুর থানায় একটি জিডি করেন। এরপর মানবাধিকার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জনৈক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ হারান বিশ্বাসের কাছ থেকে তার মেয়েকে উদ্ধার করে দেয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা নিয়ে চলে যান। কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও মেয়েকে ফিরে না পেয়ে রবীন্দ্র্রনাথের দ্বারস্থ হন হারান বিশ্বাসের। তখন রবীন্দ্র্রনাথ হারান বিশ্বাসের কাছে আবারও মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। হারান বিশ্বাস টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার সাথে খারাপ আচরণ করেন কথিত মানবাধিকার কর্মকর্তা রবীন্দ্র্রনাথ ঘোষ। পরবর্তীতে এ ঘটনা নিয়ে থানা পুলিশের দ্বারস্থ হন হারান বিশ্বাস।
এদিকে ঝিনাইদহ জেলায় শুস্ক মৌসুমে অবৈধভাবে মাটির ব্যবসা চলে রমরমা। ইটভাটা মালিকরা এসব মাটি কিনে থাকেন। সারা জেলায় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এদের কাছে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ উঠেছে। যারা এ চাঁদাবাজি করছেন তারা কোন সাংবাদিক নন। তারা পুকুর কাটার খবর পেলেই দল বেঁধে চলে যান সেখানে। এককালীন কিছু টাকা নিয়ে ও মাসিক চুক্তি করে চলে আসেন। হাটে- বাজারে গজিয়ে ওঠা কোয়াক ডাক্তাররাও এদের হাত থেকে বাদ যাচ্ছেন না। সবাই এই চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সমাজ বিরোধী ও মাদকসেবীদের একটি বড় অংশ এখন সাংবাদিক সেজে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এদের চলাচল বেশি। বেশ কয়েকবার এরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে ছাড়া পেয়ে গেছেন। স্কুল -কলেজে নিয়োগ নিয়ে এই চক্রটি প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। সভাপতির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের ভয় দেখিয়ে সম্প্রতি নগরবাথান এলাকার একটি স্কুলে দলবেঁধে হানা দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয এ চক্রের সদস্যরা। ঝিনাইদহ শহরের আলফালাহ ও শামীমা ক্লিনিকে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মোটা অংকের টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনভাবেই এই প্রতারক চক্রকে থামানো যাচ্ছে না। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তরাও এ বিষয়ে নীরব রয়েছেন। এই চক্রের বিরুদ্ধে আবার পাল্টাপাল্টি সংবাদও প্রচার হচ্ছে। টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব বেঁধে গেলে নিজেরাই অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে খবর প্রচার করছে । অনেক ভুক্তভোগী আবার প্রতিকার না পেয়ে নিজেদের ফেসবুকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কে কখন কত টাকা নিয়েছেন তা প্রচার করছেন। জেলাজুড়ে এমন কর্মকান্ডে পেশাদার সাংবাদিকরা হতাশ ও অসহায় হয়ে পড়েছেন। এছাড়া পুলিশ পরিচয় দিয়েও প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা সেলিম জানিয়েছেন, এমন প্রতারণার খবর আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত আসছে। আমরা একটি অভিযোগ ফাইল খুলেছি। প্রশাসনের পাশাপাশি এ বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
মানবাধিকার কর্মী ও জেলার সিনিয়র সাংবাদিক অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, আমি শুনেছি বেশ কিছুদিন ধরে একটা প্রতারক চক্র মানবাধিকার কর্মকর্তা পরিচয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকাতে প্রতারণা করে আসছে। এরা নিয়োগকৃত স্থানীয় সোর্সদের মাধ্যমে এ কাজ করে থাকে। এদের বিরুদ্ধে সামজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে গণমাধ্যমে এদের প্রতারণার বিষয় তুলে ধরতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। নইলে পেশাদার সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।
কোটচাঁদপুরের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে কোটচাঁদপুর থানার ওসি মঈন উদ্দিন জানান, মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দিয়ে এরা থানায় একবার তদন্ত করার নামে এসেছিল। আমাদের এক উপ-পরিদর্শককে হুমকি-ধমকিও দিয়েছিল। তখনই তাদের কার্যক্রম নিয়ে সংশয় বোধ করেছিলাম। পরবর্তীতে তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে এক ভুক্তভোগী আমাদের অবগত করেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments