ইজিবাইকচালক রাশেদ হত্যায় জড়িত মিলন যেভাবে পিবিআই’র পাতা ফাঁদে ধরা পড়েন

0

মীর মঈন হোসেন মুসা ॥ সপ্তাহখানেক আগে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর রাশেদ উদ্দিন নামে একজন ইজিবাইক বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরদিন অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের একটি মৎস্যঘের থেকে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু কে বা কারা তাকে খুন করেছিলো তা জানতেন না স্বজনেরা। অবশ্য পুলিশ ও স্বজনদের ধারণা হয়, ইজিবাইক ছিনতাইয়ের জন্য তাকে হত্যা করেছে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা। তবে শেষ পর্যন্ত হত্যার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সেই দুর্বৃত্তদের শনাক্ত ও আটক করতে সক্ষম হয়েছিলেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশেনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা।
কীভাবে হত্যাকারীদের শনাক্ত ও আটক করা হয় সেই অভিযানের কাহিনী শোনা যাক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই এর এসআই ডিএম নূর জামালের কাছ থেকে। তিনি বলেন, গদখালীর জসিম উদ্দিনের ছেলে রাশেদ গত ২ মার্চ সকালে প্রতিদিনের মত ইজিবাইক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। দিনভর বাড়ি ফিরে না আসায় রাত ৮টার দিকে তার মা রেহেনা খাতুন ছেলের কাছে মোবাইল ফোনে কল করে করে খোঁজখবর নেন। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন সকালে অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের একটি মৎস্যঘেরে তার লাশ পাওয়া যায়। এ খবর পেয়ে পিবিআই কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান এবং তদন্ত শুরু করেন। এক পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে তারা জানতে পারেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার দিন সকালে মিলন নামে এক যুবকের সাথে রাশেদের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিলো। মিলন বাঘারপাড়া উপজেলার বারভাগ গ্রামের মৃত নিজাম উদ্দিন মোল্লার ছেলে। ফলে পিবিআই কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়, রাশেদ হত্যার পেছনে মিলনের হাত থাকতে পারে। ফলে তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, মিলন একটি হত্যা মামলার আসামি। একজন চালককে হত্যা করে তার ইজিবাইক ছিনতাই করায় এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি মিলন। এ কারণে সন্দেহ আরও ঘণীভূত হয়। গোপন সূত্রে খবর পাওয়া যায় যে, মিলন তার স্ত্রী আয়েশাকে নিয়ে ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের একটি ভাড়া থাকেন। ৩ মার্চ সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মিলনকে ধরতে কৃষ্ণনগর গ্রামে যাওয়া হয়। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যায়, মিলন বাসায় নেই। স্ত্রী আয়েশা দুই শিশু সন্তান নিয়ে বাসায় রয়েছেন। এ কারণে মিলনকে ধরতে পিবিআই সদস্যরা ওই বাসার আশপাশে গোপন ওঁৎ পেতে থাকেন। মিলন বাসায় ফিরে আসলেই তাকে ধরার জন্য রাতভর ওঁৎ পেতে থাকা হয়। মশার কামড়ে তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত। তবে মিলন হয়ত কোনোভাবে বুঝতে পারে, পুলিশ তাকে ধরতে বাসার আশপাশ অবস্থান নিয়ে আছে। এ কারণে রাতে আর মিলন বাসায় ফিরে আসেননি। পরদিন ৪ মার্চ দুপুরে ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে মিলনের স্ত্রী আয়েশাকে হেফাজতে নেওয়া হয়। আয়েশার কাছে কোনো মোবাইল ফোন ছিলো না। বাসার আশপাশে পুলিশ ওঁৎ পেতে আছে বুঝতে পারলেও স্বামীকে জানাতে পারেননি বলে জানান আয়েশা। এরপর অন্য এক ব্যক্তির মোবাইল ফোন দিয়ে স্বামীর সাথে কথা বলতে বলেন পিবিআই কর্মকর্তারা। স্ত্রীকে ব্যবহার করে ফাঁদ পেতে মিলনকে ধরতে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু মিলন অত্যন্ত ধুরন্ধর। পুলিশ চলে গেছে বলার পরও স্ত্রীর এই কথায় বিশ্বাস করেননি মিলন। তবে বিকেল ৩টার দিকে স্ত্রী আয়েশাকে যশোরের শংকরপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে তার সাথে দেখা করতে বলেন। যথারীতি আয়েশাকে শংকরপুর বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে আসা হয়। তাকে আলাদা রেখে কয়েকজন পিবিআই সদস্য লুঙ্গি পরে ছদ্মবেশে তার চারপাশের সামান্য দূরত্ব রেখে অবস্থান করতে থাকেন। কিছু সময় পর দেখা যায়, একজন যুবক ওই আয়েশার কাছে এসে কথা বলছেন। সাথে সাথে মিলন সন্দেহে তাকে আটক করা হয়। কিন্তু আয়েশা জানান, এই যুবক মিলন নন। আর ওই যুবক জানান, পুলিশ আছে কি-না খবর নিতে মিলন তাকে পাঠিয়েছিলো। এরই মধ্যে কাছেই সন্দেহভাজন আরেক যুবককে দেখা গেলে তাকেও আটক করা হয়। তখন আটক দ্বিতীয় যুবক জানান, প্রথম যুবককে পুলিশ আটক করলো কি-না তা দেখতে তাকে পাঠিয়েছিলেন মিলন। কিন্তু মিলন তাদের ফাঁদে পা না দেওয়ায় ফের আয়েশাকে দিয়ে ফোন করানো হয়। তখন মিলন স্ত্রী আয়েশাকে একাকী একটি ইজিবাইকে করে মুড়লির মোড়ে যেতে বলেন। এর প্রেক্ষিতে সাথে সাথে লুঙ্গি পরে ছদ্মবেশে থাকা পিবিআই এর কয়েকজন সদস্যকে আগেই সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর লুুঙ্গি পরে ছদ্মবেশে থাকা পিবিআই এর একজন সদস্য ইজিবাইক চালিয়ে আয়েশাকে মুড়লি মোড়ে যান। সেখানে ইজিবাইক থেকে আয়েশাকে নামিয়ে তাকে পাশের পেট্রোল পাম্পে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে পিবিআই কর্মকর্তাদের শেখানো অনুযায়ী আয়েশা ফোন করে মিলনকে জানান, তিনি একা এসেছেন। পুলিশ নেই। দূরে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে ইজিবাইক থেকে একা নেমে পেট্রোল পাম্পের ভেতর ঢুকতে দেখেছিলেন মিলন। এ কারণে স্ত্রীর কথায় বিশ্বাস করে তার সাথে দেখা করতে পেট্রোল পাম্পে এলে পিবিআই এর পাতানো ফাঁদে ধরা পড়ে যান মিলন। চারপাশে ছদ্মবেশে থাকা পিবিআই সদস্যরা সাথে সাথে তাকে আটক করেন। সফল অভিযান শেষে মিলনকে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মিলন ও আয়েশা স্বীকার করেন যে, পূর্ব পরিচিত রাশেদের ইজিবাইক ছিনতাইয়ে উদ্দেশ্যে অনৈতিক কর্মকা-ের প্রলোভন দেখিয়ে মোবাইল ফোন করে ডেকে এনে তারা দুই জনে মিলে তাকে হত্যা করেছেন।